আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
বাঙালীর রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে
গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এক কর্মী হিসেবে আমি
গর্বিত। ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হতে পেরে আমি ইতিহাসের
কাছে চিরঋণী।’ জাকির যখন বঙ্গবন্ধুকে ‘রাখাল রাজা’
হিসেবে অভিহিত করেন তখন বাংলা ভাষা-সাহিত্য-
সংস্কৃতির একজন গবেষক হিসেবে আমার চেতন সচকিত হয়ে
ওঠে, আর তাই তো দ্বাপরে রাখাল রাজা হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ
যেখানে মথুরার শত্রু নিধন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
বাংলার জাতির পিতা তো নতুন ইতিহাসের আলোয় সেই
কাজটিই করে গেছেন বাংলাদেশে।
আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে-তিনি তো বাংলাদেশের
শ্রেষ্ঠতম ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধানতম নেতাদের
একজন, কিন্তু তিনি কেন গ্রন্থ রচনা করলেন, উত্তর জাকির
নিজেই দিয়েছেন-“প্রায়ই একটি বিষয় আমাকে খুব পীড়া দিত।
তা হলো, একটি জাতিরাষ্ট্র বিনির্মাণে ছাত্রলীগের শৌর্য-
বীর্যের ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের অনেকে জানে না। এমনকি
বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসে ছাত্রলীগের আদর্শ বুকে ধারণ করে যে
তরুণ ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে সেও এ সংগঠন সম্পর্কে
সবিস্তারে জানে না। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের সকল
ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভূমিকার ইতিহাস
নিয়ে উল্লেখযোগ্য পুস্তক নান থাকায় দেশের লাখ লাখ
ছাত্রলীগকর্মী সঠিক ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবার
পর এই ঘাটতি পূরণে কাজ করার সুতীব্র ইচ্ছা তৈরি হয় আমার।”
মূলত একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নৈতিক দায়িত্ববোধ
পালনের তাগিদেই জাকির তার এই গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন।
কিন্তু এই গ্রন্থ নিয়ে অহমিকা প্রকাশের পরিবর্তে তিনি যে
বিনয় প্রকাশ করেছেন তা অভিভূত হবার মতো, তিনি
লিখেছেন-“শেষ পর্যন্ত গত এক বছরের অসংখ্য বিনিদ্র রাতের
ফসল হিসেবে বইটি আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছে।... ছাত্রলীগের
ইতিহাসসমৃদ্ধ এই গ্রন্থ যদি এক তরুণকেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ
ছাত্রলীগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় করতে
প্রেরণা যোগায় তবেই আমরি পরিশ্রম স্বার্থক হবে।”
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান
ব্যক্তি হয়েও জাকিরের এ বিনয় সত্যি মুগ্ধ করার মতো।
“আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ” শীর্ষক গ্রন্থটি
মোট ১৯টি প্রবন্ধের সমাহার, এই প্রবন্ধগুলোকে সংক্ষিপ্ত
অধ্যায় হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। কেননা, প্রতিটি
প্রবন্ধের ভেতর ইতিহাস পরম্পরায় ছাত্ররাজনীতির অবদানের
কথা বর্ণিত হয়েছে, আর এক্ষেত্রে তথ্যসূত্র এসেছে বর্ণনার
প্রবহমানতার ভেতর স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এর জন্য লেখক কোন
পদটীকা বা সমাপ্তিটীকার আশ্রয় গ্রহণ করেননি। যেমনÑএই
গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধের শিরোনাম “ছাত্র সংগঠনের ইতিহাস”,
এই প্রবন্ধের মাধ্যমে লেখক মূলত ভৌগোলিক অবস্থানের দিক
দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে কীভাবে বিভিন্ন সামাজিক-
সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রয়োজনে কালের পরিক্রমায় ছাত্র
সংগঠন বা রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন গড়ে উঠেছিলÑসেই
ইতিহাসের নির্যাসকে গ্রন্থনা করেছেন। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে
আমরা জানতে পারি, ভারতীয় উপমহাদেশে মূলত
জ্ঞানচর্চাকেন্দ্রিক সংগঠন থেকে ক্রিতদাস প্রথার বিরোধী
আন্দোলন এবং পরিশেষে স্বদেশী আন্দোলন ও
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অভিযাত্রায় সময়ের প্রয়োজনে
রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠে, এক্ষেত্রে লেখক
আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন উপমহাদেশের প্রথম
একাডেমিক ছাত্র সংগঠন “ইয়াং বেঙ্গল” থেকে পরবর্তীতে
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামতনু লাহিড়ী, মাইকেল মধুসূদন দত্ত,
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখের
“জ্ঞানোপার্জিকা সভা”, “দেশ হিতৈষণী সভা”র পর কীভাবে
এবং কেন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠে। এই কীভাবে এবং
কেন গড়ে ওঠা ছাত্রসংগঠন সম্পর্কে উত্তর দিতে গিয়ে লেখক
অত্যন্ত বুদ্ধিদৃপ্ততার সঙ্গে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বলা মহাত্মা
গান্ধীর একটি মন্তব্য জুড়ে দিয়েছেন এভাবেÑ“তিনি (মহাত্মা
গান্ধী) বলেছিলেন, ‘বাংলার ছাত্র সমাজই ব্রিটিশবিরোধী
আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে, এ বিষয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ
নাই।” তারপর লেখক স্পষ্টই বলেছেন, শুধু ব্রিটিশবিরোধী
আন্দোলন নয়, যুগে যুগে বাংলার ছাত্রসমাজ জনগণের মধ্যে
রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যায়-অত্যাচারের
প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রেরণা যুুগিয়ে চলেছে।
পরবর্তী অধ্যায়ের মধ্যে “ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পূর্বকথা”,
“ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগ”, “যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে
ছাত্রলীগের ভূমিকা”, “আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ”,
“ছাত্রলীগের কর্মী দেশরতœ শেখ হাসিনা”, “বাঙালীর
ম্যাগনাকার্টা ছয় দফা বাস্তবায়নে ছাত্রলীগ”, “আগরতলা
মামলা ও ছাত্রলীগ”, “৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগ”, “১৯৭০-
এর সাধারণ নির্বাচন ও ছাত্রলীগ” এবং “১৯৭১-এর মহান
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ” শীর্ষক প্রবন্ধসমূহে ভৌগোলিকভাবে
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সমুদ্র উপকূলবর্তী বাংলাদেশের ভাষা,
সংস্কৃতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়াবলীর
সামগ্রিক মুক্তি তথা হাজার বছরের আত্মপরিচয়
অনুসন্ধানকারী একটি জাতির ভূখ-গত স্বাধীনতা অর্জনের পথে
ছাত্রলীগের বহুমাত্রিক অবদান ও ইতিহাস পরম্পরার
অভিযাত্রাকে লেখক দক্ষতার সঙ্গে গ্রন্থনা করেছেন।
এক্ষেত্রে তিনি কখনও উদ্ধৃত করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”র অংশ, কখনোবা
উদ্ধৃত করেছেন বাংলাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি জননেত্রী ও
বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয়
প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও
তাঁর “রচনাবলী” নির্বাচিত অংশ হতে। এছাড়া, উপর্যুক্ত
প্রবন্ধসমূহের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, লেখক প্রয়োজন
অনুসারে তাঁর প্রবন্ধের মধ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম-
ইতিহাসের অনন্য উপাদান তথা ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত
যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহার, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে
পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান
বৈষম্য দূরীকরণে প্রবর্তিত ২২ দফা, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত ৬ দফা, ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে
ছাত্রলীগ প্রবর্তিত ১১ দফা এবং ১৯৭১ খিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের
সূচনায় ছাত্রলীগ পঠিত ইশতিহার সংকলিত হয়েছে। ইতিহাসের
এই মহামূল্যবান উপাদান সংকলনের মাধ্যমে এস এম জাকির
হোসাইন “আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ” শীর্ষক
গ্রন্থটিকে শুধু ছাত্রলীগের ইতিহাসের মধ্যে সীমায়িত
রাখেননি, বরং তাঁর গ্রন্থটিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের
অভ্যূদয়ের ইতিহাসের একটি প্রামাণ্য সংকলনের মর্যাদা
দিয়েছেন।
এই গ্রন্থের পরবর্তী প্রবন্ধগুলিতে স্বাধীন বাংলাদেশের
বিভিন্ন রাজনৈতিক বিপর্যয়ে ছাত্রলীগের নৈতিক অবস্থান
এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশের আত্ম-পরিচয় সমুন্নত
রাখতে ছাত্রলীগের ভূমিকার কথা বর্ণিত হয়েছে। পরবর্তী
প্রবন্ধগুলির শিরোনাম হতেই আমার মন্তব্যের সত্যতার প্রমাণ
পাওয়া যেতে পারে, “আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলাদেশ
ছাত্রলীগ” শীর্ষক গ্রন্থের পরবর্তী প্রবন্ধগুলি হলোÑ“৭৫-
পরবর্তী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ”, “৯৮
সালের বন্যায় ছাত্রলীগের ভূমিকা”, “শামসুন্নাহার হলে
পুলিশী হামলার প্রতিবাদে ছাত্রলীগ”, “যুদ্ধাপরাধীদের
বিচার ও ছাত্রলীগ”, “দেশরতœ শেখ হাসিনার মুক্তি
আন্দোলনে ছাত্রলীগ”, “বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার রায়
কার্যকরের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ভূমিকা”, “ডিজিটাল
বাংলাদেশ বিনির্মাণের কর্মী হিসেবে ছাত্রলীগ”,
“বাংলাদেশ ছাত্রলীগ : সময়ের প্রয়োজনে” এবং পরিশিষ্টে
ছাত্রলীগের মূলনীতি “শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতি”র ব্যাখ্যাসহ
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয়
কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের তালিকা ও
ইতিহাসের আলোকে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত
সাংগঠনিকভাবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পালিত দিবস,
অনুষ্ঠান ও ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে।
সার্বিক বিচারে এস এম জাকির হোসাইন প্রণীত “আন্দোলন-
সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ” শীর্ষক গ্রন্থটিকে
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তী
ইতিহাসের পরম্পরার একটি অনন্য দলিল হিসেবে উল্লেখ করা
যায়।
গ্রন্থের নাম : আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ॥
লেখক : এস এম জাকির হোসাইন ॥ প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ ॥ প্রকাশক :
অন্বেষা প্রকাশন, বাংলা বাজার, ঢাকা ॥ প্রকাশকাল :
ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ॥ পৃষ্ঠা : ১৭৪ ॥ মূল্য : ২৭০ টাকা।
গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এক কর্মী হিসেবে আমি
গর্বিত। ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হতে পেরে আমি ইতিহাসের
কাছে চিরঋণী।’ জাকির যখন বঙ্গবন্ধুকে ‘রাখাল রাজা’
হিসেবে অভিহিত করেন তখন বাংলা ভাষা-সাহিত্য-
সংস্কৃতির একজন গবেষক হিসেবে আমার চেতন সচকিত হয়ে
ওঠে, আর তাই তো দ্বাপরে রাখাল রাজা হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ
যেখানে মথুরার শত্রু নিধন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
বাংলার জাতির পিতা তো নতুন ইতিহাসের আলোয় সেই
কাজটিই করে গেছেন বাংলাদেশে।
আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে-তিনি তো বাংলাদেশের
শ্রেষ্ঠতম ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধানতম নেতাদের
একজন, কিন্তু তিনি কেন গ্রন্থ রচনা করলেন, উত্তর জাকির
নিজেই দিয়েছেন-“প্রায়ই একটি বিষয় আমাকে খুব পীড়া দিত।
তা হলো, একটি জাতিরাষ্ট্র বিনির্মাণে ছাত্রলীগের শৌর্য-
বীর্যের ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের অনেকে জানে না। এমনকি
বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসে ছাত্রলীগের আদর্শ বুকে ধারণ করে যে
তরুণ ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে সেও এ সংগঠন সম্পর্কে
সবিস্তারে জানে না। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের সকল
ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভূমিকার ইতিহাস
নিয়ে উল্লেখযোগ্য পুস্তক নান থাকায় দেশের লাখ লাখ
ছাত্রলীগকর্মী সঠিক ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবার
পর এই ঘাটতি পূরণে কাজ করার সুতীব্র ইচ্ছা তৈরি হয় আমার।”
মূলত একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নৈতিক দায়িত্ববোধ
পালনের তাগিদেই জাকির তার এই গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন।
কিন্তু এই গ্রন্থ নিয়ে অহমিকা প্রকাশের পরিবর্তে তিনি যে
বিনয় প্রকাশ করেছেন তা অভিভূত হবার মতো, তিনি
লিখেছেন-“শেষ পর্যন্ত গত এক বছরের অসংখ্য বিনিদ্র রাতের
ফসল হিসেবে বইটি আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছে।... ছাত্রলীগের
ইতিহাসসমৃদ্ধ এই গ্রন্থ যদি এক তরুণকেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ
ছাত্রলীগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় করতে
প্রেরণা যোগায় তবেই আমরি পরিশ্রম স্বার্থক হবে।”
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান
ব্যক্তি হয়েও জাকিরের এ বিনয় সত্যি মুগ্ধ করার মতো।
“আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ” শীর্ষক গ্রন্থটি
মোট ১৯টি প্রবন্ধের সমাহার, এই প্রবন্ধগুলোকে সংক্ষিপ্ত
অধ্যায় হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। কেননা, প্রতিটি
প্রবন্ধের ভেতর ইতিহাস পরম্পরায় ছাত্ররাজনীতির অবদানের
কথা বর্ণিত হয়েছে, আর এক্ষেত্রে তথ্যসূত্র এসেছে বর্ণনার
প্রবহমানতার ভেতর স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এর জন্য লেখক কোন
পদটীকা বা সমাপ্তিটীকার আশ্রয় গ্রহণ করেননি। যেমনÑএই
গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধের শিরোনাম “ছাত্র সংগঠনের ইতিহাস”,
এই প্রবন্ধের মাধ্যমে লেখক মূলত ভৌগোলিক অবস্থানের দিক
দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে কীভাবে বিভিন্ন সামাজিক-
সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রয়োজনে কালের পরিক্রমায় ছাত্র
সংগঠন বা রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন গড়ে উঠেছিলÑসেই
ইতিহাসের নির্যাসকে গ্রন্থনা করেছেন। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে
আমরা জানতে পারি, ভারতীয় উপমহাদেশে মূলত
জ্ঞানচর্চাকেন্দ্রিক সংগঠন থেকে ক্রিতদাস প্রথার বিরোধী
আন্দোলন এবং পরিশেষে স্বদেশী আন্দোলন ও
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অভিযাত্রায় সময়ের প্রয়োজনে
রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠে, এক্ষেত্রে লেখক
আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন উপমহাদেশের প্রথম
একাডেমিক ছাত্র সংগঠন “ইয়াং বেঙ্গল” থেকে পরবর্তীতে
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামতনু লাহিড়ী, মাইকেল মধুসূদন দত্ত,
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখের
“জ্ঞানোপার্জিকা সভা”, “দেশ হিতৈষণী সভা”র পর কীভাবে
এবং কেন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠে। এই কীভাবে এবং
কেন গড়ে ওঠা ছাত্রসংগঠন সম্পর্কে উত্তর দিতে গিয়ে লেখক
অত্যন্ত বুদ্ধিদৃপ্ততার সঙ্গে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বলা মহাত্মা
গান্ধীর একটি মন্তব্য জুড়ে দিয়েছেন এভাবেÑ“তিনি (মহাত্মা
গান্ধী) বলেছিলেন, ‘বাংলার ছাত্র সমাজই ব্রিটিশবিরোধী
আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে, এ বিষয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ
নাই।” তারপর লেখক স্পষ্টই বলেছেন, শুধু ব্রিটিশবিরোধী
আন্দোলন নয়, যুগে যুগে বাংলার ছাত্রসমাজ জনগণের মধ্যে
রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যায়-অত্যাচারের
প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রেরণা যুুগিয়ে চলেছে।
পরবর্তী অধ্যায়ের মধ্যে “ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পূর্বকথা”,
“ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগ”, “যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে
ছাত্রলীগের ভূমিকা”, “আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ”,
“ছাত্রলীগের কর্মী দেশরতœ শেখ হাসিনা”, “বাঙালীর
ম্যাগনাকার্টা ছয় দফা বাস্তবায়নে ছাত্রলীগ”, “আগরতলা
মামলা ও ছাত্রলীগ”, “৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগ”, “১৯৭০-
এর সাধারণ নির্বাচন ও ছাত্রলীগ” এবং “১৯৭১-এর মহান
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ” শীর্ষক প্রবন্ধসমূহে ভৌগোলিকভাবে
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সমুদ্র উপকূলবর্তী বাংলাদেশের ভাষা,
সংস্কৃতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়াবলীর
সামগ্রিক মুক্তি তথা হাজার বছরের আত্মপরিচয়
অনুসন্ধানকারী একটি জাতির ভূখ-গত স্বাধীনতা অর্জনের পথে
ছাত্রলীগের বহুমাত্রিক অবদান ও ইতিহাস পরম্পরার
অভিযাত্রাকে লেখক দক্ষতার সঙ্গে গ্রন্থনা করেছেন।
এক্ষেত্রে তিনি কখনও উদ্ধৃত করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”র অংশ, কখনোবা
উদ্ধৃত করেছেন বাংলাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি জননেত্রী ও
বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয়
প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও
তাঁর “রচনাবলী” নির্বাচিত অংশ হতে। এছাড়া, উপর্যুক্ত
প্রবন্ধসমূহের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, লেখক প্রয়োজন
অনুসারে তাঁর প্রবন্ধের মধ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম-
ইতিহাসের অনন্য উপাদান তথা ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত
যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহার, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে
পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান
বৈষম্য দূরীকরণে প্রবর্তিত ২২ দফা, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত ৬ দফা, ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে
ছাত্রলীগ প্রবর্তিত ১১ দফা এবং ১৯৭১ খিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের
সূচনায় ছাত্রলীগ পঠিত ইশতিহার সংকলিত হয়েছে। ইতিহাসের
এই মহামূল্যবান উপাদান সংকলনের মাধ্যমে এস এম জাকির
হোসাইন “আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ” শীর্ষক
গ্রন্থটিকে শুধু ছাত্রলীগের ইতিহাসের মধ্যে সীমায়িত
রাখেননি, বরং তাঁর গ্রন্থটিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের
অভ্যূদয়ের ইতিহাসের একটি প্রামাণ্য সংকলনের মর্যাদা
দিয়েছেন।
এই গ্রন্থের পরবর্তী প্রবন্ধগুলিতে স্বাধীন বাংলাদেশের
বিভিন্ন রাজনৈতিক বিপর্যয়ে ছাত্রলীগের নৈতিক অবস্থান
এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশের আত্ম-পরিচয় সমুন্নত
রাখতে ছাত্রলীগের ভূমিকার কথা বর্ণিত হয়েছে। পরবর্তী
প্রবন্ধগুলির শিরোনাম হতেই আমার মন্তব্যের সত্যতার প্রমাণ
পাওয়া যেতে পারে, “আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলাদেশ
ছাত্রলীগ” শীর্ষক গ্রন্থের পরবর্তী প্রবন্ধগুলি হলোÑ“৭৫-
পরবর্তী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ”, “৯৮
সালের বন্যায় ছাত্রলীগের ভূমিকা”, “শামসুন্নাহার হলে
পুলিশী হামলার প্রতিবাদে ছাত্রলীগ”, “যুদ্ধাপরাধীদের
বিচার ও ছাত্রলীগ”, “দেশরতœ শেখ হাসিনার মুক্তি
আন্দোলনে ছাত্রলীগ”, “বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার রায়
কার্যকরের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ভূমিকা”, “ডিজিটাল
বাংলাদেশ বিনির্মাণের কর্মী হিসেবে ছাত্রলীগ”,
“বাংলাদেশ ছাত্রলীগ : সময়ের প্রয়োজনে” এবং পরিশিষ্টে
ছাত্রলীগের মূলনীতি “শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতি”র ব্যাখ্যাসহ
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয়
কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের তালিকা ও
ইতিহাসের আলোকে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত
সাংগঠনিকভাবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পালিত দিবস,
অনুষ্ঠান ও ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে।
সার্বিক বিচারে এস এম জাকির হোসাইন প্রণীত “আন্দোলন-
সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ” শীর্ষক গ্রন্থটিকে
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তী
ইতিহাসের পরম্পরার একটি অনন্য দলিল হিসেবে উল্লেখ করা
যায়।
গ্রন্থের নাম : আন্দোলন-সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ॥
লেখক : এস এম জাকির হোসাইন ॥ প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ ॥ প্রকাশক :
অন্বেষা প্রকাশন, বাংলা বাজার, ঢাকা ॥ প্রকাশকাল :
ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ॥ পৃষ্ঠা : ১৭৪ ॥ মূল্য : ২৭০ টাকা।
জয় হোক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এর।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ…আপনার মূল্যবান মতামত প্রদানের জন্য।
উত্তরমুছুন