অনলাইন ডেস্ক
এ যেন ছিল মরুর বুকে অনেকটা দাভোস সম্মেলনের মতো। সেখানে ছিলেন বিশ্বের প্রায় ৩ হাজার ৫০০ রাজনীতিক, শীর্ষ ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার। বলছিলাম, সম্প্রতি রিয়াদে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বিন আবদুল আজিজ আল-সৌদের ডাকা গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ সম্মেলনের কথা।
আজকের দুনিয়ায় রক্ষণশীল দেশ হিসেবে পরিচিত সৌদি আরবের অর্থনীতি প্রাকৃতিক তেলের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু দেশটির এই অর্থনীতির চাকা যেন এখন অনেকটা ধীর হয়ে আসছে। কারণ, বিশ্ববাজারে বর্তমানে তেলের দাম নিম্নমুখী। তাই এই চাকা এখন অন্য পথে ঘোরাতে হবে। এ জন্যই সৌদি যুবরাজ নিজ দেশে বিনিয়োগকারীদের টানতে ঘোষণা দিলেন তেল সংস্থা সৌদি আরামকোর শেয়ার বাজারে ছাড়া হবে। এটি সত্যি হলে আগামী বছর তা হবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আইপিও (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান।
শুধু যে তেলের শেয়ার দিয়ে বিনিয়োগকারীদের টানলেই হবে, তা তো নয়। কারণ, যেকোনো প্রাকৃতিক সম্পদ একসময় ফুরিয়ে আসবে। তাই যুবরাজ পরিকল্পনা করলেন ,এমন কিছু করতে হবে, যা বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেবে। বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠান এখানে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবে। তাই কট্টরপন্থীর লেবাস খুলে দেশ মধ্যপন্থী ইসলামের পথে ফিরে যাবে বলে ঘোষণা দিলেন যুবরাজ। স্বপ্ন দেখালেন এমন শহরের, আধুনিক জীবন বা আধুনিক পৃথিবী বলতে মানুষ এখনো যা কল্পনা করতে পারেনি। নাম
নিওম সুপারসিটি
। ৫০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে ‘নো রেস্ট্রিকশন, নো ডিভিশন, নো এক্সকিউজেস, এন্ডলেস পোটেনশিয়ালস’। অর্থাৎ কোনো বিধিনিষেধ নয়, কোনো বিভাজন নয়, কোনো অজুহাতও নয়। শুধু অপার সম্ভাবনার শহর হতে চলেছে নিওম। যেখানে সবকিছু হবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। এই শহর ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিবেচিত হবে। যেখানে বায়োটেকনোলজি থেকে শুরু করে খাবারের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকবে।
প্রশ্ন হলো, এই মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন আদৌ কি সম্ভব?
যুবরাজ বিন সালমানের কাছে নিওম শুধু একটি প্রকল্প নয়, এটা হলো স্প্রিং বোর্ড। এর ওপর থেকে লাফ দিয়ে অনেক দূর নিয়ে যাবেন রাষ্ট্রকে। এই শহর চলবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। যেখানে আকাশে ভেসে বেড়াবে ড্রোন। রোবট করবে মানুষের সব কাজ। ‘সবচেয়ে নিরাপদ, সবচেয়ে দক্ষ, সবচেয়ে ভবিষ্যৎমুখী এবং কাজ ও বসবাসের জন্য সেরা স্থান’ হিসেবে দেখতে চায় এই শহরকে।
কিন্তু সংশয়বাদীদের মনে শঙ্কা থাকতেই পারে। কারণ, এর আগে ‘স্মার্ট শহরের’ এমন পরিকল্পনা ঢাকঢোল পিটিয়ে করা হয়েছিল, বাস্তবে তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাসদার শহর। সৌদি আরবের রক্ষণশীলতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা সাবেক বাদশাহ আবদুল্লাহও করেছিলেন। তিনিও অনুধাবন করেছিলেন, সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখতে হলে নতুন নীতি গ্রহণ করতে হবে। অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা বাড়াতে, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে, অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে ‘ছয়টি অর্থনৈতিক শহর’ করার কাজ শুরু করেছিলেন। তখন তেলের দাম চাঙা থাকা সত্ত্বেও এই প্রকল্পগুলো তেমন এগোতে পারেনি; বাস্তবে যা ব্যর্থ অর্থনৈতিক মডেলে পরিণত হয়। তাই বর্তমান যুবরাজ অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য ও ধর্মীয় উদারনীতির মাধ্যমে যে নাটকীয় পরিবর্তন আনতে চাইছেন, তা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। তিনি কি পারবেন?
যা হোক, নিওমের পাশে এরই মধ্যে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া গেছে। জাপানের ‘ভিশন ফান্ড’–এর প্রধান মাসায়োশি সন, ব্ল্যাকস্টোনের প্রধান স্টিফেন শর্জম্যান, আরকোনি ও আলকোয়ার সাবেক চেয়ারম্যান এবং সিমফোনির সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লাওস ক্লেনফিল্ড নিওমের প্রধান নির্বাহী হতে পারেন। তাই হয়তো কিছুটা আস্থা রাখা যায়।
কিন্তু নিওমের সামনে এখন তিনটি বড় প্রশ্ন উঠে এসেছে দ্য ইকোনোমিস্টের পর্যবেক্ষণে। প্রথমত সময়। যতটা জোরেশোরে এই প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে, ততটা দ্রুত কি তা বাস্তবায়ন সম্ভব?
কেননা, পুরো পরিকল্পনা এখনো কাগজকলমে ও কবে নাগাদ এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষ হবে, তারও কোনো উল্লেখ নেই। সরকার বলছে, প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ৫০ হাজার কোটি ডলার আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আসবে। অথচ ২০১৪ সাল থেকে দেশের তেলের বাজার নিম্নমুখী। যার ফলে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে। চলতি বছর সৌদি আরব ঘাটতি বাজেটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা সম্ভবত দেশটির জিডিপির ৯ শতাংশ। তাই এখন যদি প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ১০০ ডলার না হয় এবং তা যদি দীর্ঘদিন ধরে রাখা না যায়, তাহলে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে—এই অর্থ আসবে কোথা থেকে? ২০১৫ সালে ৯ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ও ১৬ সালে ৭ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের ঘাটতি বাজেট ছিল। বর্তমানে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৬৩ ডলার।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, নিওম কি যেসব সৃজনশীলতার কথা বলা হচ্ছে, তা আপাদমস্তক করতে পারবে? সৌদি যুবরাজের সেই সম্মেলনে উপস্থিত রোবোটিক কোম্পানি বোস্টন ডায়নামিকের শীর্ষ কর্মকর্তা মার্ক রাইবাট মনে করেন, এর জন্য একটি ‘ধাক্কা’ দরকার।
আর তৃতীয় প্রশ্ন হলো, নিওম সফল করার জন্য যে মেধাবীদের (নারীসহ) দরকার, তাঁদের কি সৌদি আরব আনতে পারবে। আর এটি করার জন্য আজ সৌদি আরব যে অবস্থানে আছে, সেখান থেকে বেরিয়ে অনেক বেশি শিথিল ও খোলামেলা হতে হবে।
এটা সত্যি যে সম্প্রতি এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। সৌদি যুবরাজ নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন। তবে নারীরা এই সুযোগ ভোগ করবেন আগামী বছরের মাঝামাঝিতে। এ ছাড়া এখন নারীরা গ্যালারিতে গিয়ে খেলা দেখতে পারবেন। যদিও অনেকে এর পেছনের কারণ মনে করছেন ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে নারীদের বাইরে কাজ করতে হবে। এ জন্যই এ পদক্ষেপ। আরব গলফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র রেসিডেন্ট স্কলার ক্রিস্টিন স্মিথ দিওয়ান বলেন, ‘যেহেতু সৌদি আরবের তেলের ওপর নির্ভরতা ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ছে, তাই রাজতন্ত্রের এখন ব্যাপক উৎপাদনশীল কর্মশক্তি দরকার...এবং সেখানে নারীদেরও প্রয়োজন।’
সৌদি আরবের অন্য অর্থনৈতিক শহরগুলো গড়ে ওঠার সময় বলা হয়েছিল, দেশটির তরুণ প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা হবে। বর্তমানে দেশটির মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ তরুণ। এদের এক–চতুর্থাংশ বেকার। কিন্তু নিওম কোনো কর্মসংস্থান তৈরির কথা বলছে না। যুবরাজ বিন-আবদুল্লাহ ব্লুমবার্গকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সৌদি জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করতে নিওম নয়; নিওম হবে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের প্রাণকেন্দ্র।
সৌদি আরব থেকে বিচ্ছিন্ন এই শহর নিয়ে যুবরাজ যে স্বপ্ন দেখছেন, সেই স্বপ্নের পথে অনেক বাধাও আসতে পারে। কেননা, দীর্ঘদিনের রক্ষণশীল মনমানসিকতার সৌদি লোকজন এ বিষয়টা হয়তো স্বাভাবিকভাবে নেবে না। একইভাবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যে এখনই দৌড়ে চলে আসছেন, তেমনটাও নয়। কারণ, তাঁরা সৌদি আরবে আগের বাদশাহদের নেওয়া প্রকল্পগুলোর অবস্থা দেখবেন, দেখবেন একটি রক্ষণশীল দেশের পক্ষে আদৌ তা বাস্তবায়নযোগ্য কি না। সব হিসাব–নিকাশ কষেই তাঁরা মাঠে নামবেন।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকসের সহযোগী অধ্যাপক স্টিফেন হারটগের মতে, ‘এখনো কেউ কথা দেয়নি। সামনে এগোনোর আগে বিনিয়োগকারীরা বিস্তারিত ভেবে দেখবেন।...কিন্তু যেহেতু সৌদি আরবের এখন আর আগের মতো আর্থিক জৌলুশ নেই, তাই বেসরকারি বিনিয়োগ না অাসা পর্যন্ত তারা বেড় ধরনরে কিছু করতে পারবে না।’
‘নিওম’ শব্দটি এসেছে গ্রিক ‘নিও’ (যার অর্থ নতুন) আর আরবি ‘মুস্তাকবাল’–এর (ভবিষ্যৎ) ‘ম’ থেকে। এই নতুন ভবিষ্যতের দিকে নজর এখন সবার। সৌদি যুবরাজ এই প্রতিশ্রুতি তা কি পূরণ করতে পারবে, নাকি আকাশছোঁয়া উঁচু ভবনগুলো অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকবে অথবা রাজনৈতিক দমনপীড়নের মধ্য দিয়ে ব্যস্ত থাকবে...নাকি শহুরে অর্থনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েই থাকবে।
দ্য ইকোনমিস্ট ও হাফিংটন পোস্ট অবলম্বনে লিপি রানী সাহা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
ধন্যবাদ…আপনার মূল্যবান মতামত প্রদানের জন্য।